ফুটবলের মহাতারকা লিওনেল মেসি | অনুপ্রেরণার এক সংগ্রামী জীবন

Author:

Published:

Updated:

ফুটবল জগতে এক অনন্য নাম লিওনেল মেসি । দেখতে ছোটখাট ক্ষিপ্র গতির এই ফুটবল জাদুকরের নামের পাশে যে বিশেষণ যোগ করা হোক না কেনো তা বাহুল্যমাত্র ।

যেমন করে একসময় ফুটবল বলতে পেলে, ম্যারাডোনা বুঝাতো ঠিক তেমনি বর্তমানে ফুটবল বলতে জাদুকর মেসিকে বুঝায় একথা বলার অপেক্ষা রাখে না ।

আজকের লিওনেল মেসি কীভাবে মেসি হয়েছেন, সেই গল্প খুব কম মানুষই জানি ।

যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয়, বর্তমান ফুটবলারদের মধ্যে আপনার প্রিয় খেলোয়াড় কে?

নিশ্চিতভাবে তিনটি নাম-ই সবচেয়ে বেশি আসবে-

১. লিওনেল মেসি
২. ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এবং
৩. নেইমার

যদি কেউ বর্তমান ফুটবলের বিন্দুমাত্র কোন খোঁজখবর জানেন, তবে নিশ্চিত করে বলা যায়, এই তিনজনকে তিনি চেনেন কিংবা অন্তত নাম শুনেছেন ।

ফাইভ ফিঙ্গার্স প্রোডাকশনের জীবনী সিরিজে তিন পর্বে আমরা এই তিন কিংবদন্তী খেলোয়াড়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী আপনাদের জন্য তুলে ধরবো ।

পড়ে আসুনঃ নেইমারের সংক্ষিপ্ত জীবনী

ছোট্ট একটা উদাহরণ দেওয়া যাক । লিওনেল মেসি কতটা জনপ্রিয় ফুটবলার ?

ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসি
লিওনেল মেসি

আর্জেন্টিনায় মেসির নাম সংক্রান্ত একটা আইন করা হয়েছে যে, সদ্যজাত শিশুদের নাম মেসি রাখা যাবে না । আর্জেন্টিনায় মেসি নামটি এতো বেশি মানুষের নাম হয়ে গেছে যে, বিশেষজ্ঞদের কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে- আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মেসি নামের মানুষ এতো বেশি বেড়ে যাবে যে, প্রত্যেককে আলাদাভাবে চিহ্নিত করাটাই বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে ।

আপনার আশেপাশে একটু খোঁজ নিলে জানতে পারবেন- মেসিকে নিয়ে তার ভক্তদের মধ্যে কতটা উন্মাদনা !

আমরা সবাই মোটামুটি একজন সফল মেসিকে চিনি, কিন্তু আজকের লিওনেল মেসি কীভাবে মেসি হয়েছেন, সেই গল্প খুব কম মানুষই জানি । এবার শুনুন তাহলে মেসির কঠিন সংগ্রামী জীবন থেকে উঠে আসার গল্প, তার সফলতার কথা ।

১১ বছর বয়সে এসে মেসি হোঁচট খেয়ে পড়ল একটি কঠিন রোগের কাছে

মেসির জন্ম ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন, আর্জেন্টিনার রোসারিওতে । তার বাবা জর্জ মেসি একটি ফ্যাক্টরিতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন । আর মা সেলিয়া মারিয়া ছিলেন একজন খণ্ডকালীন পরিচ্ছন্নতা কর্মী । পরিবারের সদস্য বলতে বাদবাকি মেসির বড় দুইভাই ও বোন ।

৫ বছর বয়স থেকে মেসির ফুটবল যাত্রা । প্রথম হাতেখড়ি ফুটবল প্রিয় বাবার কাছে । তারপর বাসার কাছেই স্থানীয় ক্লাব গ্রান্দোলির হয়ে খেলা শুরু । ১৯৯৫ সালে মেসি নিজের শহর রোসারিওর নিওয়েল’স ওল্ড বয়েজে’র হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন ।

ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসি
লিওনেল মেসি

সেই ছোটবেলায়- মাত্র ৯ বছর বয়স তার, মেসি কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে ফুটবলে এতোটাই পারদর্শী হয়ে উঠেন যে, তার পায়ে একবার বল গেলে কমপক্ষে ১৫ মিনিটের মধ্যে অন্য কারো সাধ্য নেই মেসির পা থেকে বল কেড়ে নেয় ।

দর্শকরা মাঠের বাইরে থেকে মেসির এই নৈপুণ্য দেখে ক্রমাগত সিস বাজিয়ে খেলা আরও জমিয়ে তুলতো ।

তুমি যদি কোনকিছু মন থেকে চাও, যদি তোমার উদ্দেশ্য সৎ হয় এবং তার জন্য কঠোর পরিশ্রম করো, তখন সারা পৃথিবী এক হয়ে যাবে তোমার চাওয়া পূর্ণ করতে ।

ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসি

মেসির জীবনে সবকিছুই ভালো ভাবে এগোচ্ছিল । কিন্তু ১১ বছর বয়সে এসে মেসি হোঁচট খেয়ে পড়ল একটি কঠিন রোগের কাছে । একটি গ্রোথ হরমোনের ওভার রয়েছে তার । যে কারণে সমবয়সীদের চেয়ে তার বৃদ্ধি কম । দ্রুত সময়ের মধ্যে এই রোগের চিকিৎসা না করালে তার গ্রোথ অস্বাভাবিকভাবে কমে যাবে । অথচ চিকিৎসাও অত্যন্ত ব্যয়বহুল ।

রোগের চিকিৎসা হিসেবে প্রতিদিন এক যন্ত্রণাদায়ক ইনজেকশন তার পায়ে পুশ করা হত । প্রথম ৭ দিন এক পায়ে, পরের সাত দিন অন্য পায়ে ।

১১ বছর বয়সী শিশু মেসির জন্য কতটা কঠিন সময় ছিল এটা ভাবুন । মেসির এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা কয়েকবছর পর্যন্ত চলে, কিন্তু এর ফলে এক পর্যায়ে তাদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ হতে থাকে ।

ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসি
লিওনেল মেসি

প্রতি মাসে সেসময় মেসির জন্য ১৫০০ ডলার খরচ করতে হত, যা তার দিনমজুর বাবার পক্ষে বহন করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল । তিনি ঠিকমত মেসির চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারছিলেন না ।

মজার ব্যাপার ছিল । এই কঠিন সময়েও মেসি তার প্রিয় ফুটবলকে ছাড়েনি । বরং এর পেছনে তার পরিশ্রম, অধ্যাবসায়ের জোর বাড়তেই থাকে । যন্ত্রণা নিয়েও মেসি নিয়মিত ফুটবল প্র্যাকটিস করতেন ।

একটা কথা প্রচলিত আছে, তুমি যদি কোনকিছু মন থেকে চাও, যদি তোমার উদ্দেশ্য সৎ হয় এবং তার জন্য কঠোর পরিশ্রম করো, তখন সারা পৃথিবী এক হয়ে যাবে তোমার চাওয়া পূর্ণ করতে । মেসির ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে ।

কিংবদন্তী প্লেয়ার গেলট মুলার মার্কের ১৯৭২ সালে করা এক বছরে সর্বোচ্চ ৮৫ গোলের রেকর্ডটি ভেঙ্গে দেন 

ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসি
লিওনেল মেসি

তার চিকিৎসা প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ে মেসির জীবন অন্য দিকে মোড় নেয় । মেসির খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে তার কোন একজন শুভাকাঙ্ক্ষী বার্সেলোনার তৎকালীন ক্রীড়া পরিচালক কার্লেস রেক্সাচকে মেসির প্রতিভার কথা জানান । মেসির অদ্ভুত সুন্দর খেলার গল্প শুনে কৌতূহলী হয়ে তিনি নিজেই চলে আসেন মেসির খেলা দেখতে । এবং একটি ছোট বাচ্চাছেলে মেসির এই ফুটবল নৈপুণ্য দেখে তিনি অবাক হয়ে গেলেন ।

এরপর তিনি মেসির পরিবারের সাথে তার চিকিৎসার ব্যাপারে একটি প্রস্তাব দিলেন । মেসির পুরো চিকিৎসার খরচ বহন করবে বার্সেলোনা কিন্তু বিনিময়ে মেসিকে স্পেনে এসে বার্সেলোনার হয়ে খেলতে হবে । মেসির পরিবার সানন্দে রাজী হলেন এই প্রস্তাবে । মেসির বয়স ১৪, পরিবার নিয়ে স্পেনে তাদের বসবাস শুরু ।

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সংক্ষিপ্ত জীবনী

বার্সেলোনার যুব একাডেমী লা মাসিয়া’র হয়ে তার খেলা শুরু । তার ফুটবল যাদু দিয়ে অল্প দিনেই সবাইকে জয় করে ফেললেন মেসি । ১৬ নভেম্বর ২০০৩ সাল, মেসির বয়স তখন ১৬ বছর ১৪৫ দিন । মেসি প্রথম বার্সেলোনার হয়ে মাঠে নামেন ।

 ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসি
লিওনেল মেসি

তারপর ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট, হাঙ্গেরির বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন । এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে । একের পর এক রেকর্ড বুকে জায়গা করে নিতে শুরু করলেন । ২০১২ সালে এক বছরে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গোল করে গিনিজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নিজের নাম লেখান ।

সে বছর তার গোলের সংখ্যা ছিল ৯১ টি । এর মাধ্যমে তিনি জার্মানির আরেক কিংবদন্তী প্লেয়ার গেলট মুলার মার্কের ১৯৭২ সালে করা এক বছরে সর্বোচ্চ ৮৫ গোলের রেকর্ডটি ভেঙ্গে দেন । ২০০৪ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তিনি বার্সেলোনার হয়ে ৩৪৮ টি ম্যাচ খেলে ৩১২ টি গোল করেন ।

ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসি
লিওনেল মেসি

স্প্যানিশ লা লিগাতে ৩০০ গোল করা একমাত্র ফুটবলার লিওনেল মেসি । ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে খুব সাধারণ আর্জেন্টিনা দল নিয়ে একমাত্র তার নৈপুণ্যে ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে যায় আর্জেন্টিনা । আর মেসি জিতে নেন বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে গোল্ডেন বল ।

এসব ছাড়াও তিনি এমন কিছু রেকর্ড করে ফেলেছেন, যা অন্য কোন প্লেয়ারের জন্য ভাঙ্গা প্রায় দুঃসাধ্য ।

কি জানলাম আমরা মেসির জীবন থেকে? সাফল্য লাভের জন্য কতটা পিপাসার্ত ছিলেন তিনি? কতটা অধ্যাবসায়ি? এবং কি কঠোর পরিশ্রমই না করে গেছেন নিজের স্বপ্ন পূরণে ।

২০০৪ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তিনি বার্সেলোনার হয়ে ৩৪৮ টি ম্যাচ খেলে ৩১২ টি গোল করেন ।

ভেবে দেখেছেন তার জীবনেও কতটা খারাপ সময় এসেছিল? একটা কথা মনে রাখবেন, বড় সমস্যা সেই মানুষদেরই আসে, যিনি সমাধান করার ক্ষমতা রাখেন এবং একটি বড় সাফল্যে লাভের জন্য অনেকবার ব্যর্থ হলেও স্বপ্ন থেকে পিছপা হোন না ।

ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসি
লিওনেল মেসি

আপনার আশে পাশে যদি এমন কোন মানুষ থাকে যার এই লেখাটি পড়া উচিত বলে মনে করেন , তার সাথে অবশ্যই শেয়ার করবেন । অনুপ্রেরণামূলক গল্প, সফল ব্যক্তিদের জীবনী, সফলতার সূত্র এবং জীবনের নানান সমস্যা আপনাদের পাশে আছে পাই ফিঙ্গার্স মোটিভেশন ।

সফলতা কেবল আপনার জন্যই ।

Latest posts

  • ডিজিটাল মার্কেটিং কি? ডিজিটাল মার্কেটিং কেন প্রয়োজন?

    ডিজিটাল মার্কেটিং কি? ডিজিটাল মার্কেটিং কেন প্রয়োজন?

    ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কোন পণ্য বা সেবার মার্কেটিং করাকে এককথায় ডিজিটাল মার্কেটিং বলে। খুব সহজে ডিজিটাল মার্কেটিং কি এর সংজ্ঞাটা দেওয়া হলেও ডিজিটাল মার্কেটিং এতোটাও সহজ কিছু না। আপনি যদি ডিজিটাল মার্কেটিং কি? ডিজিটাল মার্কেটিং কীভাবে করে? ডিজিটাল মার্কেটিং এর সুবিধা কি, অসুবিধা কি, ডিজিটাল মার্কেটিং পেশা হিসেবে কেমন- এই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিতভাবে জানতে…

    Read more

  • জাকারবার্গ এবং ফেসবুকের গল্প | কীভাবে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিবেন

    জাকারবার্গ এবং ফেসবুকের গল্প | কীভাবে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিবেন

    বর্তমানে ফেসবুক ব্যবহার করে না এমন মানুষ খুজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আমরা অনেকেই মার্ক জাকারবার্গ এর ফেসবুকের গল্প জানি । একটি ছোট্ট রুম থেকে সারা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পরে সকল ভাষাভাষী মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাসকে বদলে দিয়েছে ফেসবুক । কি ভাবে মার্ক জাকারবার্গ করলেন এটা ? আপনি কি জানেন জাকারবার্গকে তার স্বপ্নের জন্য কি কি ত্যাগ করতে…

    Read more

  • বিয়ার গ্রিলসের হার না মানা গল্প

    বিয়ার গ্রিলসের হার না মানা গল্প

    ডিসকভারি চ্যানেলে ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড অনুষ্ঠানটি দেখেননি এমন লোক কমই পাওয়া যাবে । অনুষ্ঠানটি যার কারণে সারা বিশ্বে এতো জনপ্রিয়তা পেয়েছে তিনি হচ্ছেন এডওয়ার্ড মাইকেল বিয়ার গ্রিলস (Bear Grylls) । সবার কাছে বিয়ার গ্রিলস নামেই পরিচিত। তিনি একাধারে একজন লেখক, টেলিভিশন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, সাবেক সেনা কমান্ডো ও বর্তমানে বিশ্ব স্কাউট সংস্থার চীফ অব স্কাউট ।…

    Read more